ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ভয়ঙ্কর নয়

ড. মিহির কান্তি মজুমদার

করোনাভাইরাস সৃষ্ট বর্তমান বৈশ্বিক মহামারীর সময় ব্ল্যাক ফাঙ্গাস আতঙ্ক নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। ভারতের তামিলনাড়–, গুজরাট, ওড়িশা, রাজস্থান, তেলেঙ্গানা- এসব রাজ্যে এবং দিল্লীতে ইতোমধ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংশ্লিষ্ট রোগ মিউকরমাইয়োসিসকে মহামারী ঘোষণা করা হয়েছে। হোয়াইট ফাঙ্গাস, ইয়েলো ফাঙ্গাসের কথাও শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশে বারডেম হাসপাতালে তিনজন রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। পত্রিকায় খবর ও নিবন্ধ প্রকাশ হচ্ছে। টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে নিত্যদিন ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের খবর থাকছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্রকে নিয়মিত বুলেটিনে তাই বলতে হয়েছে ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক স্বাস্থ্য অধিদফতরের গভীর পর্যবেক্ষণে রয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারবে না।’ অথচ ব্ল্যাক ফাঙ্গাসসহ কোটি কোটি অনুজীব নিয়েই আমাদের বসবাস ও বেড়ে ওঠা। এ ফাঙ্গাস মাটিতে, জৈব সারে, পচনশীল পদার্থে এবং বাতাসে আছে ও থাকবে। ফল, শাক-সবজিতে নিয়মিত ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের আক্রমণ ঘটে এবং কীটনাশক দিয়ে তা নিবারণ করা হয়। মানুষের মধ্যে এ রোগের সংক্রমণ খুব কম।

প্রাথমিক পর্যায়ে এ্যান্টিফাঙ্গাল মলম ব্যবহারই যথেষ্ট। তবে মস্তিষ্কে বা গুরুত্বপূর্ণ সংবেদনশীল অঙ্গে ছড়িয়ে গেলে এ রোগে মৃত্যুর হার প্রায় ৫০ শতাংশ। মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক সন্দেহ নেই, কিন্তু আক্রান্তের হার খুবই নগণ্য। কারণ সুস্থ শরীরে বা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল থাকলে এ ফাঙ্গাস কিছু করতে পারে না। রক্তে গ্লুকোজ বেশি বা ডায়াবেটিক রোগী, ক্যান্সার বা অন্য কোন মারাত্মক রোগে আক্রান্ত রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে এ ফাঙ্গাসের সংক্রমণ ঘটার আশঙ্কা থাকে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ বা কোভিড রোগের কারণে রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এ রোগের চিকিৎসায় ডেকসামিথাসোন, মিথাইল প্রেডনিসোলোন জাতীয় স্টেরয়েড ওষুধ ব্যবহার করা হয়। কোভিড চিকিৎসায় এ স্টেরয়েড ভাল কাজ করে। কিন্তু পাশর্^প্রতিক্রিয়া হিসেবে সাময়িক সময়ের জন্য রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেয়। কোভিডের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধির এ সুযোগটিই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস গ্রহণ করে থাকে।

সে প্রেক্ষাপটে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ সম্পর্কে একটু সচেতন থাকলেই হয়, আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই। বরং প্রচার করা প্রয়োজন যে, ফাঙ্গাসসহ প্রায় সকল অনুজীব আমাদের অত্যন্ত উপকারী। ১৯২৮ সালে পেনিসিলিয়াম প্রজাতির ফাঙ্গাস থেকেই আলেকজান্ডার ফ্লেমিং প্রথম এ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করেন। এ আবিষ্কারই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রধান ভিত্তি বা গোড়াপত্তন। কিন্তু যে নীরব কালো ঘাতক আমাদের মধ্যে দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করছে সে সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার ও সচেতন না থাকাটাই আতঙ্কের বিষয়। কোটি কোটি ফাঙ্গাস, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রটোজোয়া ইত্যাদি অতিক্ষুদ্র জীব বা অনুজীব আমাদের শরীরের মধ্যেই আছে। একজন মানুষের শরীরে যে পরিমাণ অনুজীব আছে তার ওজন গড়ে কম-বেশি ১.৫ কেজি এবং এর সংখ্যা মানুষের শরীরে যে পরিমাণ কোষ আছে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি। এর প্রায় সবই উপকারী অনুজীব। অনুমান করা হয় পৃথিবীতে প্রায় এক ট্রিলিয়ন অর্থাৎ এক লাখ কোটি প্রজাতির অনুজীব আছে এবং প্রতি ১০০ কোটি প্রজাতির অনুজীবের মধ্যে গড়ে একটি প্রজাতি প্যাথোজেন বা রোগ সৃষ্টিকারী অনুজীব হয়। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত ৯৯.৯৯ শতাংশ প্রজাতির অনুজীবের বৈশিষ্ট্য, চরিত্র এখনও আবিষ্কার করা হয়নি। যে কোটি কোটি অনুজীবের বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার হয়েছে এর মধ্যে আজ পর্যন্ত মাত্র ১৪০০ অনুজীবকে প্যাথোজেন হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। আমাদের খাদ্য হজম প্রক্রিয়া ও পরিপাকতন্ত্রের সুরক্ষায় হাজার হাজার প্রজাতির প্রায় এক লাখ ট্রিলিয়ন অনুজীব অংশগ্রহণ করে। একজন মানুষের আঙ্গুলের ছাপ যেমন আরেকজনের থেকে আলাদা, তেমনি একজনের হজম প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত কোটি কোটি অনুজীবের অনুপাত ও কার্যক্রম সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের চামড়া, নাক, গলা, মুখ এবং নাড়িভুঁড়িতেই এদের প্রধান আবাসস্থল ও কার্যক্রম। একজন মানুষের নাভিতেই গড়ে প্রায় ৪০০০ প্রজাতির অনুজীব বসবাস করতে পারে।

যে নীরব কালো ঘাতক সম্পর্কে আমরা সচেতন হচ্ছি না তা হচ্ছে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। বাংলাদেশ হেলথ ও ডেমোগ্রাফিক সার্ভের (BDHS)২০১৭-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী এ দেশে ৩৫ বছর ও তদুর্ধ মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের হার ৪০ শতাংশ এবং ডায়াবেটিসের হার ১৪ শতাংশ। ২০১১ সালের প্রতিবেদনে উচ্চ রক্তচাপের হার ছিল ২৬ শতাংশ এবং ডায়াবেটিসের হার ছিল ১১ শতাংশ। আর ২০০১ সালে ডায়াবেটিসের হার ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। দেশে প্রায় এক কোটি ডায়াবেটিক রোগী আছে এবং এর কম-বেশি ৬০ শতাংশই জানেন না যে, তাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি বা তারা ডায়াবেটিক রোগী এবং তাদের চিকিৎসা প্রয়োজন। BDHS-এর ২০১৭-২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক তথা ১৮ বছর ও তদুর্ধ বয়সের ডায়াবেটিক রোগীর হার ১২.৪ শতাংশ এবং প্রি-ডায়াবেটিক ১৪ শতাংশ, যারা অচিরেই ডায়াবেটিক রোগীর মিছিলে শামিল হবেন। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগ, কিডনি, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করে এবং অকালমৃত্যু ঘটায় বা প্রায় পঙ্গুত্ব সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে শুধু ডায়াবেটিস ও এ রোগ সৃষ্ট জটিলতার চিকিৎসার জন্য প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার বা ১৩০০০ কোটি টাকা খরচ হয় বলে সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে। এর সাথে রোগীর উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়া বা মৃত্যু/পঙ্গুত্বের কারণে উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার মূল্য যোগ করলে তা বৃদ্ধি পাবে কয়েকগুণ। শর্করাভিত্তিক খাদ্য বেশি খাওয়া, লবণ, কম কায়িক পরিশ্রম, জাঙ্ক ফুড, জীবনযাত্রার পরিবর্তন, ব্যায়াম না করা ইত্যাদির কারণে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ এই দুই নীরব কালো ঘাতক তাদের শাখা-প্রশাখা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বিস্তার করে চলেছে।

ভারত সরকার তাদের ৫ রাজ্যে এবং দিল্লিতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সৃষ্ট রোগকে মহামারী ঘোষণা করেছে। ভারত এমনিতেই বিশ্বের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণের সূতিকাগার। বিশ্বে যদি ১০১ ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ ঘটে, তার ৮৩ ভারতে ঘটে বলে সমীক্ষায় দেখা গেছে। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস অথবা অতিরিক্ত স্টেরয়েড গ্রহণের রোগী। বিশ্বে যেখানে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের হার প্রতি দশ লক্ষে ০.০০৫ থেকে ১.৭ জন, সেখানে ভারতে এ হার ৮০ গুণ বেশি। কারণ ওই অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস বা অতিরিক্ত স্টেরয়েড ব্যবহার। ভারতের স্বাস্থ্য সেক্টরের দাফতরিক পোর্টালে দেখা যায়, সে দেশে শতকরা ১২ থেকে ১৮ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগ আছে। গ্রামের চেয়ে শহরাঞ্চলের রোগীর সংখ্যা একটু বেশি। মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বাইয়ের প্রখ্যাত ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ হেমন্ত থ্যাকারের ভাষায়, ‘ভারত হচ্ছে বিশে^র ডায়াবেটিকের রাজধানী’। ডায়াবেটিস, কোভিড রোগ এবং স্টেরয়েড- এ ত্রয়ী অশুভ শক্তির আতাতের ফসল হচ্ছে ব্যাপক ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ। ভারতের প্রায় ৩০ লক্ষ কোভিড রোগীর মধ্যে ৫ থেকে ৭ হাজার জন ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়েছেন। ত্রয়ী অশুভ শক্তির কারণে এটা হতেই পারে। এজন্য দিল্লির ফরটিস হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডাঃ অনুপ মিশ্র বিদ্যমান অবস্থাকে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের মাত্রাতিরিক্ত সংক্রমণ বলে আখ্যায়িত করেছেন, মহামারী নয়। যাহোক, আমরা যেমন ভৌগোলিকভাবে ভারতের প্রতিবেশী, তেমনি ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ রোগের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রেও আমরা তাদের নিকটতম প্রতিবেশী। সে প্রেক্ষাপটে কোভিড রোগের এ বৈশ্বিক মহামারীর সময় কোভিডে আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগী বা স্টেরয়েড গ্রহণকারী রোগীর ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। তবে ইনসুলিনের আবিষ্কারক স্যার ফ্রেডরিক বেন্টিং-এর জন্মদিন ১৪ নভেম্বর প্রতি বছর ‘বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস’ এবং ১৭ মে ‘বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস’ পালনের পাশাপাশি এ দুই নীরব কালো ঘাতকের বিষয়ে আমাদের অনেক কার্যক্রম নিতে হবে। সামান্য এক ব্ল্যাক ফাঙ্গাস যেভাবে মিডিয়ায় প্রচার পেয়েছে এবং স্বাস্থ্যা বিভাগের পর্যবেক্ষণ আকর্ষণ করতে পেরেছে সে তুলনায় উক্ত দুই নীরব কালো ঘাতকের অঘোষিত মহামারী প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচার ও কর্মসূচি গ্রহণ করা বেশি প্রয়োজন। দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সরকারি-বেসরকারি সেক্টরের স্বাস্থ্যাসেবা প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সকলে এ বিষয়ে সচেতন থাকা ও একটু কার্যক্রম নিলেই এই দুই নীরব কালো ঘাতকের আক্রমণ থেকে অনেকটা পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে।