ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের অনুপ্রবেশ ও করণীয়

ড. মিহির কান্তি মজুমদার

করোনা প্রজাতির সপ্তম ভাইরাস সার্স-কভ-২-এর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টসহ অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টে পর্যুদস্তু বৈশ্বিক জনজীবন ও অর্থনীতি যখন জাগতে শুরু করেছে ঠিক তখনই নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে বিশ্বে। এতদিন কোভিড-১৯-এর চেয়ে করোনার নামে বৈশ্বিক মহামারী বেশি পরিচিতি পেয়েছে। ওমিক্রন আবার এ পরিচিতিকে কিছুটা দুর্বোধ্য করেছে। চীনের উহান থেকে করোনা প্রজাতির সার্স-কভ-২ নামক ভাইরাস ইতোমধ্যে বহুবার নিজের আকৃতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন করেছে। এটা সকল ভাইরাসের জীবনাচরণ। যদিও ভাইরাস কোন পূর্ণাঙ্গ প্রাণ নয়। পরজীবী আধা-প্রাণ বলা যায়। পূর্ণাঙ্গ প্রাণ নয় বলে ভাইরাস নিজে বংশ বিস্তার করতে পারে না। কোন জীবের দেহকোষের প্রোটিনের সংস্পর্শে এসে বিলীন হয় এবং ঐ দেহকোষকে সংক্রমিত করে নিজের প্রতিলিপি তৈরি করে। এভাবে দ্রুত গতিতে পার্শ্ববর্তী দেহকোষকে সংক্রমিত করতে থাকে। শরীরের সহজাত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ওহহধঃব রসসঁহরঃু) প্রথমেই এ সংক্রমিত কোষকে ধ্বংস করে শরীরকে সুস্থ রাখে। তখন ভাইরাস এ প্রাথমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা এড়ানোর কৌশল হিসেবে নিজের আকৃতি ও প্রকৃতি পরিবর্তন শুরু করে। এ পরিবর্তনকে মিউটেশন বলে এবং পরিবর্তিত রূপকে বলে ঐ ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট। উহান থেকে বিস্তার লাভ করা করোনা প্রজাতির ভাইরাসের প্রথম ভ্যারিয়েন্ট আলফা বিগত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যে, বেটা ভ্যারিয়েন্ট দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং অক্টোবরে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রথমে ভারতে শনাক্ত হয়। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সারাবিশ্বে সংক্রমণ ও অত্যন্ত মারণঘাতী হিসেবে মৃত্যুর আতঙ্ক সৃষ্টি করে। করোনা ভাইরাসের এ রূপান্তর প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ওমিক্রন। জিম্বাবুইয়েতে খেলতে যাওয়া ক্রিকেটাদের সংক্রমণের মাধ্যমে বাংলাদেশেও সম্প্রতি এর অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

ভাইরাস বা এর ভ্যারিয়েন্টের নামকরণ করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সংশ্লিষ্ট কারিগরি পরামর্শক কমিটি। সহজবোধ্য করার জন্য সাধারণত গ্রীক বর্ণমালার অক্ষর দিয়ে এরূপ নামকরণ করা হয়। সে প্রক্রিয়ায় উক্ত বর্ণমালার প্রথম দিকের ০৩টি বর্ণ দিয়ে আলফা, বেটা ও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের নামকরণ করা হয়েছে। ওমিক্রন গ্রীক বর্ণমালার ১৫তম বর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে শনাক্তকৃত নতুন ভ্যারিয়েন্টের নামকরণ করা হয়েছে এই ওমিক্রন বর্ণের নামানুসারে। নামের এ ছন্দ পতনের ন্যায় ওমিক্রনের আকৃতি ও চরিত্রেও ঘটেছে অনেক পরিবর্তন।

করোনাভাইরাসের চারদিকে অতি সূক্ষ্ম স্পাইক বা কাঁটা আছে ২৪ থেকে ৪০টি। এ স্পাইকের একটি অংশ হচ্ছে প্রোটিন, যার কাজ হচ্ছে আক্রান্ত দেহকোষে লেগে গিয়ে সংক্রমণ ঘটানো। শরীরের সহজাত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এ স্পাইক বা কাঁটাকে আক্রমণ করে তাদের দেহকোষে সংক্রমণে বাধা সৃষ্টি করে। পাশাপাশি ভ্যাকসিন দেহকোষে এন্টিবডি সৃষ্টি করে এবং এ এন্টিবডিও সহজাত প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে সংক্রমণ প্রতিরোধে অংশগ্রহণ করে। শরীরের এ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এড়িয়ে সংক্রমণ ঘটানোর জন্য ভাইরাসও তার অবয়ব ও প্রকৃতি পরিবর্তন করে নতুন ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টি করে। এ প্রক্রিয়ায় করোনার বর্তমান প্রজাতির ভাইরাস আলফা (যুক্তরাজ্য), বেটা (দক্ষিণ আফ্রিকা), গামা (ব্রাজিল), ডেল্টা (ভারত), এপসিলন (যুক্তরাষ্ট্র), জিটা (ব্রাজিল), ইটা (যুক্তরাজ্য), থিটা (ফিলিপিন্স), আইওটা (যুক্তরাষ্ট্র), কাপ্পা (ভারত), ল্যামডা (পেরু) এবং শেষে ওমিক্রন রূপে (দক্ষিণ আফ্রিকা) আতœপ্রকাশ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার বিজ্ঞানী এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ওমিক্রনের বহিরাবরণের স্পাইকে পরিবর্তন হয়েছে অনেক বেশি। সংক্রমণের সুযোগসন্ধানী এসব স্পাইকে যেখানে বেটা ভ্যারিয়েন্টে ০৩টি ও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে ০২টি মিউটেশন বা রূপান্তর হয়েছে, সেখানে ওমিক্রনের স্পাইকে পরিবর্তনের সংখ্যা ১৫ বা তার বেশি। তাছাড়াও অন্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ওমিক্রনের স্পাইক অত্যন্ত নমণীয়। সে কারণে এগুলো দিক পরিবর্তন করে দেহকোষের প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুর্বল স্থান শনাক্ত করে এবং সেখানে আটকে গিয়ে সংক্রমণ ঘটায়। সে হিসেবে বিজ্ঞানীদের মতে, ওমিক্রনের সংক্রমণ ক্ষমতা অত্যন্ত মারণঘাতী, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কোন ভাইরাসে সংক্রমণের পরপরই সংক্রমিত ব্যক্তির শরীরে সৃষ্টি হয় এন্টিবডি। ভ্যাকসিনও এক প্রকার নির্বিষ সংক্রমণ হিসেবে শরীরে ঐ ভাইরাসের এন্টিবডি সৃষ্টি করে। প্রিটোরিয়া হাসপাতাল সূত্রে জানা যায় যে, আগে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে এমন ব্যক্তিও ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছে। উপসর্গেও আছে অনেক পরিবর্তন। ওমিক্রন আক্রান্ত ব্যক্তির মুখের স্বাদ বা নাকে গন্ধ না থাকা, গায়ে জ্বরÑ এসব উপসর্গ নেই। শুধু একটু কাশি আছে এমন রোগীর সংখ্যাই বেশি। তাছাড়া অন্য ভ্যারিয়েন্টে শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠী খুব একটা আক্রান্ত না হলেও ওমিক্রন সংক্রমণে তারা ছাড় পায়নি।

কাজেই সংক্রমণ ক্ষমতার দিক থেকে অন্য সব ভ্যারিয়েন্ট থেকে ওমিক্রন অনেক বেশি শক্তিশালী এবং ভ্যাকসিনসৃষ্ট বা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এড়িয়ে ওমিক্রন সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। এজন্য বিজ্ঞানীরা বিদ্যমান টিকার বুষ্টার ডোজ দিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থার সময়কালকে দীর্ঘ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে কতদিন বা কত সময় তা দীর্ঘায়িত করা যাবে তার কোন তথ্য-প্রমাণ নেই। দ্রুত সংক্রমণ ক্ষমতা এবং দেহাবরণে অনেক রূপান্তরের কারণে এটি মারাত্মক মারণঘাতী হতে পারে। ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১ তারিখে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ‘ঙসরপৎড়হ রং ধ উৎবংং জবযবধৎংধষ ভড়ৎ ঃযব হবীঃ ঢ়ধহফবসরপ’। আবার অনেক রূপান্তরের সমন্বিত তথা মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় মারণঘাতী ক্ষমতা কমিয়ে দিতেও পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এটি কিরূপ হবে তা নিয়ে এখন শত শত গবেষক কাজ করছেন। কোনকিছুই এ মুহূর্তে পরিষ্কার নয়। দিগন্তে তাই আতঙ্কের মেঘ ও সংক্রমণ ঝড়ের আশঙ্কা ছাড়া অন্য কোন পূর্বাভাস নেই। তবে আশার কথা হচ্ছে যে, বিশ্বের ৬০টি দেশে এ পর্যন্ত ওমিক্রন সংক্রমণের চিত্র পাওয়া গেলেও এ সংক্রমণে মৃত্যুর কোন খবর নেই। আশার আলো শুধু এটুকুই।

মানুষের জন্য মারণঘাতী ভাইরাসের মধ্যে এখন পর্যন্ত একটি ভাইরাস পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়েছে। সেটি হচ্ছে গুটি বসন্তের জন্য দায়ী ভেরিওলা ভাইরাস। পোলিও ভাইরাস আমাদের দেশ থেকে নির্মূল হলেও পাকিস্তান, আফগানিস্তানে এখনও আছে। ব্লাক ডেথ হিসেবে পরিচিত বিউবোনিক প্লেগ রোগ চতুর্দশ শতকে ৫ কোটির বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছিল। ইঁদুর, কাঠবিড়ালীর মাধ্যমে ছড়ানো এ রোগ বা ভাইরাসের উপস্থিতি এখনও আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে। ১৯১৮ সালে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারী স্প্যানিশ ফ্লু-এর কারণে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হয়েছিল এবং এর মধ্যে ৫ কোটির বেশি মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয়েছিল। এসব রোগ ও ভাইরাস এখনও আছে। মাঝে-মধ্যে কোন অঞ্চলে আঞ্চলিক রোগ হিসেবে (ঊহফবসরপ) আত্মপ্রকাশ করে। কাজেই বৈশ্বিক মহামারী সৃষ্টিকারী করোনা প্রজাতির বর্তমান ভাইরাসও অদূর ভবিষ্যতে নির্মূল হবে এমন আশা করার কোন কারণ নেই। এমনিতে আমরা সাধারণ সর্দি-কাশি বা ঠা-া লাগার সঙ্গে সম্পর্কিত করোনা প্রজাতির ৪টি ভাইরাসের সঙ্গে বসবাস করছি অনেক দিন ধরে। ওমিক্রনসহ করোনার অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে সেভাবেই বসবাস করতে হবে আমাদের। স্বাস্থ্যসচেতন থাকা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, বিদ্যালয় এবং কমিউনিটিতে স্বাস্থ্য শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যথাযথ রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে রক্তের শ্বেত কণিকা, অস্থিমজ্জা, প্লীহা, লিভার, টনসিল, থাইমাসসহ অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং কোষের উপাদান সম্পর্কিত। জন্মের সময় পাওয়া তথা সহজাত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার পাশাপাশি শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। সঙ্গে আছে খাদ্য, পুষ্টি ও অনুপুষ্টি, সুস্থ থাকা, ব্যায়াম, স্বাস্থ্যসচেতনতা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়। কাজেই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অটুট রাখার প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্য ও পুষ্টি শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

দেশে প্রতিবছর ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত গতিতে। অসচেতনতা ও সংশ্লিষ্ট কারণে সহজাতভাবে বাড়ছে হৃদরোগ, ক্যান্সার, কিডনি, স্ট্রোক ও মানসিক রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। করোনার তা-ব থেকে তা আঞ্চলিক রোগে রূপ নিতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, কিডনি রোগ ও অন্যান্য রোগের দাপটে লাগাম টানতে সময় লাগবে। আমরা একটি চিকিৎসামুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও মানসিকতা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সৃজনে বিশেষ কর্মসূচী নিয়ে এ উত্তরাধিকার থেকে বের হতে হবে। শিক্ষাঙ্গন থেকে কমিউনিটি পর্যন্ত স্বাস্থ্য শিক্ষা এক্ষেত্রে যথেষ্ট ভাল ভূমিকা রাখতে পারবে, যা ওমিক্রন এবং আগামীর অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ প্রতিরোধেও কাজ করবে।

সে প্রেক্ষাপটে বর্তমান সময়ে ওমিক্রন এবং করোনার অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ মোকাবেলায় সাবান দিয়ে ঘনঘন হাত ধোয়া, নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহার করা, জানালা-দরজা খুলে কক্ষে বাতাস প্রবাহের ব্যবস্থা করা, বদ্ধ স্থান এবং জনসমাগমের স্থান এড়িয়ে চলা, হাঁচিও কাশির সময় রুমাল/টিস্যু বা কনুই ব্যবহার করা, স্বাস্থ্যসচেতন থাকা এবং টিকা নেয়াই সবচেয়ে ভাল ও কার্যকর উপায়। পাশাপাশি স্বাস্থ্য শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণ করতে হবে।